ডেক্স নিউজ : আমাদের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলো। যে সব স্থানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। কিছুক্ষণ পর চুয়াডাংগার সাথে যোগাযোগ হলো। চুয়াডাংগাকে আমরা বিপ্লবী সরকারের রাজধানী করার পরিকল্পনা মনে মনে ঠিক করেছি। পরদিন দেখি, সংবাদপত্রে এই খবর প্রকাশিত হয়ে গেছে। এই খবর ফাঁস না করার জন্যে ডাঃ আসবাহুল হককে আমি আগেই অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম, আনন্দের আতিশয্যে বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে তিনি তা বলে দিয়েছেন। ডাঃ আসহাবুল হক, মেজর ওসমান ও তওফিক এলাহীর সাথে আমাদের ফোনে যোগাযোগ হল। মেজর ওসমানকে বললাম তার সাথে খুব সহসাই আমাদের দেখা হবে। তিনি বেশ প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদের একটি তালিকা তৈরী করে রাখেন। সেদিন ছিল কলকাতায় ‘বন্দ’। বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে এই বন্দ ডাকা হয়। কলকাতার জনজীবন একেবারে স্তব্ধ। গাড়ী ঘোড়া সব কিছু বন্ধ। কলকাতার ভাইরা সেদিন আমাদের আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। কলকাতাস্থ পাক সরকারের কার্যালয়ের চারদিকে হাজার হাজার জনতা বিক্ষোভ প্রকাশ করেছে। আমাদের জন্য একটা বাড়ী দরকার। রুস্তমজী বাড়ীর সন্ধানে আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
পাকিস্তান কনস্যুলেট এর কাছে আমাদের জন্য একটি বাড়ী নির্বাচিত করা হলো। ঘরে ফিরেই তাজউদ্দিন ভাই ও আমি তিনটি খসড়া পরিকল্পনায় হাত দেই। এগুলো হলো দলের সাংগঠনিক, সরকার গঠন ও সামরিক পরিকল্পনা কাজ। যা মাথায় তাই লিখেছি। সাথে সাথে ছক কেটে তীর চিহ্ন দিয়ে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরী করেছি। এরপর মুক্তিযুদ্ধের জন্য সারাদেশকে কয়টি ভাগে ভাগ করা হয়। পরদিন আমাদের দিল্লী যাওয়ার কথা। বিএসএফ ও অন্যেরা খুবই সাবধানতা অবলম্বন করছে আমাদের অবস্থান গোপন রাখার জন্য। পরদিন সকালে সীমান্তের দিকে যাই। খবর অনুযায়ী মেজর ওসমান অস্ত্রশস্ত্রের একটা তালিকা তৈরী করে নিয়ে আসেন। মেজর ওসমানকে কিছু অস্ত্র দেয়া হলো। এর মধ্যে এলএমজিও ছিল। ইতিমধ্যে খবর এলো স্যৈনরা যশোর সেনানিবাস থেকে বের হবার চেষ্টা করছে। তাকে এক্ষুণিই যেতে হবে। মেজর ওসমান সদ্য পাওয়া এলএমজি কাঁধে নিয়ে দ্রুত রওয়ানা হলেন। চুয়াডাংগা, কুষ্টিয়া, যশোর অঞ্চলে স্বাধীনতা যুদ্ধে মেজর ওসমানের সাথে তার স্ত্রীও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই তেজস্বী মহিলা অশেষ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সাহসী এই বীরের স্ত্রী বেগম ওসমান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন। একদিকে তিনি স্বামীকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিতেন, অপরদিকে বিডিআর জোয়ান ও মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি অনুপ্রাণিত করতেন। নিজের হাতে রান্না করে তিনি যুদ্ধ শিবিরে পাঠিয়ে দিতেন। ১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর রাতে সেনা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে বেগম ওসমান নিহত হন।
১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল। আজ আমরা দিল্লী যাচ্ছি। গোলক মজুমদার আমাদের সাথে আছেন। সরজিৎ চট্টপাধ্যায়ের বিমানবন্দরে আমাদের সাথে দেখা করার কথা রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট কক্ষে আমাদের বসা ব্যবস্থা করা হয়। সাংবাদিক ও অন্যান্য যাত্রীর দৃষ্টি এড়িয়ে আমাদের যেতে হবে। ইতিমধ্যেই চট্টপাধ্যায় আমাদের দুজনের জন্য একটি স্যুটকেস ও একটি ব্যাগ নিয়ে এসেছেন। হাত ব্যাগে কাগজপত্র, কলম, পেন্সিল ইত্যাদি রয়েছে। স্যুটকেসে আমাদের পরিধেয় কাপড়, তোয়ালে ও সাবান। রাত ১০টার দিকে জীপে করে মিলিটারী মালবাহী বিমানের কাছে আমাদের নিয়ে আসা হল। মই দিয়ে আমরা বিমানের ককটিটে উঠি। পাইলট ও তার সহকারীদের ছাড়া বিমানে বসার অন্য কোন আসন নেই। শুধুমাত্র ক্যানভাসের বেল্ট দিয়ে আমাদের চারজনের বসার একটি ব্যবস্থা করা হল। বিমানের পিছন দিক উন্মুক্ত। এ দিয়ে অনায়াসে উঠা নামা করা যায়। তখনও এতে মাল ভর্তি ছিল। এই মালবাহী সামরিক বিমানে নেয়ার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সকল এজেন্সী থেকে আমাদের যাত্রা গোপন রাখা। এটা ছিল একটি পুরনো রাশিয়ান বিমান। এর শব্দ ছিল বিকট। বিমানের যাত্রা শুরু হল। সমস্ত ককপিট কাঁপছে। তাজউদ্দিন ভাই বেশ চেষ্টা করেও ওভাবে বসে থাকতে পারলেন না।
দিল্লী পৌঁছতে রাত শেষ হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর একটা ক্যানভাস বিছিয়ে আমি ও তাজউদ্দিন ভাই মেঝেতে শুয়ে পড়ি। গরমে আমরা ঘামছিলাম। বিমানের কাপনের সাথে আমাদের শরীরও কাঁপছিল। এমনি করে আধা ঘুমে আধা জাগা ভোরের দিকে আমরা দিল্লী পৌঁছি। সেখানে মিলিটারী বিমানবন্দরে আমাদের জন্য একটি গাড়ী প্রস্তত ছিল। একজন কর্মকর্তা আমাদের নিয়ে গেলেন। চট্টপাধ্যায় আমাদের সাথে ছিলেন। মজুমদার গেলেন তাঁর মেয়ের বাসায়। প্রতিরক্ষা কলোনীর একটি বাড়ীতে আমাদের রাখা হলো। পরে জেনেছি বাড়ীটি ছিল বিএসএফ এর একটি অতিথিশালা। এ বাড়ীতে অন্য আর কেউ নেই। আমি ও তাজউদ্দিন ভাই এক ঘরে, চট্টপাধ্যায় অন্য ঘরে। আমাদের ঘরে দুটি বিছানা রয়েছে। ঢাকা থেকে বেরোবার পর থেকে দু’জন একত্রেই থাকছি। এতে সুবিধা অনেক। রাতে ঘুম না আসা পর্যন্ত সব কিছু পর্যালোচনা করার সুযোগ পাই। গোলক মজুমদার ও রুস্তমজী ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আমাদের বৈঠকের ব্যবস্থা করার কাজে লিপ্ত রয়েছেন। আমাদের কিন্তু বিলম্ব সইছে না। ইতিমধ্যেই দিল্লীর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা প্রশ্ন তুলেছে যে মহম্মদ আলী প্রকৃতই তাজউদ্দিন আহমদ এবং রহমত আলী ব্যারিষ্টার আমীর উল ইসলাম কিনা। ভারতের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার আচরণে কখনো অবাক হয়েছি আবার কখনো ভীত হয়েছি। তবে ‘র’ নামক গোয়েন্দা সংস্থা মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় খুবই ব্যস্ত ছিল। এই সংস্থাটির কার্যকলাপে কখনই আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাদের সাথে আলাপ করে। তারা নিশ্চিত হতে চায় আসলেই আমরা আওয়ামী লীগের লোক কিনা। তাদের আলোচনার পর সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মিঃ কাউলের কিছুটা বিশ্বাস জন্মে যে সত্যিই আমরা আওয়ামী লীগের লোক। মেজর ওসমানের অস্ত্রের তালিকাটা তখনো আমার পকেটে। কথায় কথায় মিঃ মীরন আমাদের জানান যে, আলোচনার মাধ্যমে অস্ত্র পেতে আমাদের বিলম্ব হবে। মিঃ মীরনের কাছে আরো জানতে পারি, লন্ডনে মিনহাজ উদ্দিনের সাথে তাদের কথা হয়েছে। আমাদের কোন খবর থাকলে তিনি তা পৌঁছে দিতে পারেন। মিনহাজ আমার পূর্ব পরিচিত।
আমি তাকে চিঠি লিখি। আমি চিঠিতে অস্ত্রের একটা তালিকা পাঠাই। তাকে জানাই, লন্ডনস্থ বাঙ্গালীরা ইচ্ছা করলে আমাদের জন্য অস্ত্রের ব্যবস্থা করতে পারে। তখনো বুঝে উঠতে পারিনি অস্ত্র কেনা ও তা সরবরাহ করা তত সহজ নয়। ইতিমধ্যে আমরা খবর পেলাম, রেহমান সোবহান ও আনিসুর রহমান দিল্লীতে পৌঁছেছেন। তাছাড়া এম আর সিদ্দিকী, সিরাজুল হক বাচ্চু মিয়া ও যুবনেতা আব্দুর রউফ তখন দিল্লীতে ছিলেন। তাদের সকলের সাথে আলাদা আলাদাভাবে আমাদের বৈঠক হয়। এম আর সিদ্দিকীর কাছে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের মোটামুটি কিছু খবর পাই। তার কাছে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠের কাহিনীও শুনি। তিনি জানান, মেজর জিয়া একটা জীপে করে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা এক প্রকার জোর করে জিয়াকে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করান। তিনি আরো জানান, চট্টগ্রাম থেকে তারা একটি ট্রান্সমিটার আগরতলাতে নিয়ে এসেছেন এবং তা দিয়ে প্রচার কাজ চালানো হচ্ছে। ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ও জনগণ তাদেরকে সর্বপ্রকার সাহায্য করেছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। একটি সরকার গঠন করার জন্য তিনি আমাদের অনুরোধ জানান। কর্মীদের প্রতি শুভেচ্ছা নিয়ে তিনি আগরতলা চলে যান। তবে তাকে সরকার গঠন করার ইঙ্গিত দিয়ে দিলাম। আব্দুর রউফকে কিছু নির্দেশসহ রংপুর পাঠিয়ে দেই। এসময় ময়মনসিংহ থেকে রফিকউদ্দিন ভূইয়া ও সৈয়দ আব্দুস সুলতানের চিঠি পেলাম। সৈয়দ সুলতান বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এমনিভাবে দিল্লী আসার পর ২ দিন কেটে গেল। ইতিমধ্যে রুস্তমজী ও গোলক মজুমদার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেছেন।
আমরা তাদের দু’জনকে এ কথা বুঝাতে সক্ষম হই যে, বাঙ্গালী হলেও আমাদের জাতীয়তাবোধ ও জাতীয় সত্ত্বা বাংলাদেশের ভু-খন্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমরা আমাদের ৫৪ হাজার বর্গ মাইল ভু-খন্ডের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী ৪ঠা এপ্রিল তাজউদ্দিন ভাই ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাৎকালে তাদের কোন সহযোগী ছিল না। বৈঠকে উপস্থিত না থাকলেও পূর্বাপর আলোচনার বিষয় আমার জানা ছিল। সাক্ষাতে যাওয়ার পূর্বে তাজউদ্দিন ভাই আমার সাথে কয়েক ঘন্টা ধরে সম্ভাব্য আলোচ্য সূচী নিয়ে আলোচনা করে যান। মিসেস গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের পর তাজউদ্দিনের ভাই আমাকে সব কিছু জানান। মিসেস গান্ধী বারান্দায় পায়চারী করছিলেন। তাজউদ্দিনের ভাই এর গাড়ী পৌঁছে যাওয়ার পর তাকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ষ্টাডি রুমে নিয়ে যান। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী প্রথম প্রশ্ন করেন “হাউ ইজ শেখ মুজিব, ইজ হি অল রাইট?” এই প্রশ্ন সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। কেননা এই প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদেরকে আরো অনেক বার হতে হয়েছে। মিসেস গান্ধীর প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দিন ভাই বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু’ আমাদেরকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর স্থান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ২৫মার্চের পর তাঁর সাথে আমাদের আর যোগাযোগ হয়নি। সাক্ষাতে তাজউদ্দিন ভাই আরো বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোন মূল্যেই এই স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে।