আবদুল্লাহ মাহফুজ অভি : দূর্গাপুরের বিরিশিরির উৎরাইল বাজার থেকে একটু এগুলেই সোমেশ্বরী নদী। নদী পার হয়ে আমরা যাচ্ছিলাম বহেরাতলী গ্রামের দিকে। ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহে গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক টঙ্ক আন্দোলনের নেত্রী-সংগঠক কুমুদিনী হাজংয়ের বাড়ির দিকে।
পথেই পরলো টঙ্ক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধের সামনে রোদে শুকাতে দেয়া হয়েছে ধান। একজন কৃষাণী পা দিয়ে নেড়ে নেড়ে সেই ধান শুকাচ্ছে। এই ধান আর জমিনের জন্যই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিলো কুমুদিনী হাজংদের। স্মৃতিসৌধকে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যাই এই ঐতিহাসিক আন্দোলনকারীদের ভেতর বেঁচে থাকা একমাত্র মানুষটির বাড়িতে। যার নাম কুমুদিনী হাজং। টঙ্ক আন্দোলনকারীদের ভেতর একমাত্র কুমুদিনী হাজংই বেঁচে আছেন ইতিহাসের জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে।
মধ্য দুপুরে আমরা পৌঁছাই তার বাড়ি। ছোট একটি টিলার উপর ছোট একটি ঘর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন উঠান। চারিদিকে ফুলের গাছ।
ঢাকা থেকে তার সাথে দেখা করতে কয়েকজন এসেছেন এমন খবর পেয়ে বের হয়ে এলেন ঘর থেকে। বয়সের ভারে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। স্মৃতিও এখন ধূসর। আন্দোলনের সেইসব দিনের কথা ভুলে গেছেন। তবুও সেই সংগ্রামের কথা তুললে স্মৃতি হাতরে মাঝে মাঝে কিছু কিছু ঘটনা বলেন। কথা শুরু হতেই ধীর কন্ঠে বললেন, ‘আমি কেমনে কইতাম? সেই সব কি মনে আছে? এখন বয়স হইছে আর কত? এইবার আমারে বিদায় দাও। কোনো দিকে যাইতে পারি না আমি।’
‘আপনাকে আমাদের মাঝে অনেক বছর দরকার। আপনিইতো ইতিহাসের সুন্দরমুখ’ এই কথার জবাবে মৃদু হাসলেন এই বিপ্লবী নারী। কিছুক্ষণ থেমে বললেন, ‘একবারতো আমি গেছিলাম গা (প্রায় মারা যাচ্ছিলাম), ডাক্তার আমারে সুই ভরলো (স্যালাইন পুশ করে শরীরে), আমি দেখে রাগ হইছি। কইছি এটা কিতা দিছো? কিচ্ছু দরকার নাই। আমার এখন যাওনের সময়…।’
ঘুরে ফিরে কুমুদিনী হাজং শুধু বিদায়ের কথা বলছিলেন। এর আগেও তার সাথে কয়েকবার সাক্ষাত করার সুযোগ হয়েছিলো। কিন্তু এবারই যেন বারবার বলছিলেন বিদায়ের কথা।
খাজনা আদায়ের নামে কৃষকদের ধান কেড়ে নিয়ে যে শোষণ চলতো তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ গড়ে শুরু হয়েছিলো ঐতিহাসিক টঙ্ক আন্দোলন। কমরেড মনি সিংয়ের নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালে এই আন্দোলন বড় আকার ধারন করলে শুরু হয় অত্যাচার। আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার নির্যাতন।পুলিশি অত্যাচারের মুখে গা ঢাকা দেয় পুরুষরা। ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি আন্দোলনকারীদের ধরতে অভিযান চালায় পুলিশ। গ্রাম পুরুষ শূণ্য থাকায় ২ হাজং নারীকে ধর্ষণ করা হয়। কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজং ও তার ভাইকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে তাদের বাড়িতে অভিযান চালায়, এ সময় তাদের না পেয়ে কুমুদিনী হাজংকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আন্দোলনকারীদের সন্ধান দেয়ার জন্য। কোনো উত্তর না পেয়ে তাকে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খবর পেয়ে রাসমনি হাজংয়ের নেতৃত্বে মহিলারা রুখে দাঁড়ায়। তারা কুুমুদিনী হাজংকে ছেড়ে দিতে বলে। পুলিশ এসময় গুলি চালালে রাসমনি হাজং ও তার সহযোদ্ধা সুরেন্দ্র হাজং শহীদ হন। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া লড়াই চলে। কিন্তু গ্রামবাসী শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে কুমুদিনী হাজংকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হন।
এই কুমুদিনী হাজংকে ঘিরেই সেদিন ছড়িয়ে পরেছিলো আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৫০ সালে বাতিল হয় টঙ্ক প্রথা। সময়ের সাথে সাথে একে একে বিদায় নিয়েছেন সেই অগ্নি সময়ের বিপ্লবী সন্তানেরা। তাদের ভেতর শুধু মাত্র কুমুদিনী হাজং বেঁচে আছেন। টঙ্ক আন্দোলনের ইতিহাসের শেষ মানুষ!
অর্থনৈতিক দারিদ্রতা থাকলেও যে জীবন তিনি বয়ে চলছেন সেই জীবন এক কিংবদন্তীর জীবন। বন বিভাগের আওতাধীন এক টুকরো জমির উপর তার পরিবার নিয়ে বসবাস। ক্ষুধা আর দারিদ্রতা নিয়েই কেটে গেলো পুরো জীবন। যে জমি-ধানের জন্য তাদের লড়াই করতে হয়েছিলো সেই জমিও শেষ পর্যন্ত দখল হয়ে যায় পাকিস্তানি শাষণ আমলে। তবুও মাথা নত করেননি। সংগ্রাম করেই কাটিয়ে দিলেন পুরোটা জীবন।
উদাস চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বললেন ‘জমিজমা নাই, কিচ্ছু নাই। সব গেছে গা… এইখানে জঙ্গল ছিলো। সব সাফ কইরা সুন্দর কইরা যখন ঘর উঠাইছি তখন ফরেস্টার (বনবিভাগের কর্মী) আইসা কয় এইটা বন বিভাগের জমি। কি কইতাম?’
নানা রকম গল্প কথায় অনেকটা সময় পার করে যখন বিদায় নিচ্ছিলাম তখন পেছনে তাকিয়ে দেখি হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছেন। যেন কোনো বিরান বন্দরে দাঁড়িয়ে জাহাজ ভর্তি স্বজনদের বিদায় দিচ্ছেন নিঃসঙ্গ এক মানুষ।
Leave a Reply