ডেক্স নিউজ : নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরূপ সারাবিশ্বে একশত বছর ধরে এই দিবস পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে ঘটা করে প্রতি বছর এই দিবস পালিত হয়। দীর্ঘ শতবর্ষ পার হলেও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং আমাদের চারপাশে তাকালে দেখি নারী নানাভাবে শোষণ, বৈষম্য, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারী নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। নারীকে মর্যাদা না দেয়ার মূল কারণ সম্পদ এবং সম্পত্তিতে নারীর অধিকার না থাকা এবং সকল সম্পদ-সম্পত্তিতে বেশির ভাগ পুরুষের আধিপত্য থাকায় পুরুষ দিনে দিনে পরাক্রমশালী হয়ে উঠছে, আর নারী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে পুরুষের উপর। ফলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে মানুষের মর্যাদা না দিয়ে তাকে ভোগের সামগ্রী করা হয়েছে। এসব কারণে নারীর উপর চলে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতন। এই সব সমস্যার কারণে পারিবারিক সংস্কৃতি একটি বৈষম্য ও নির্যাতন ভিত্তিক পারিবারিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যাতে করে একটি অসুস্থ পরিবার, অসুস্থ সমাজে পরিণত হচ্ছে এবং অসুস্থ সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে দিনে দিনে অসুস্থ মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে একটি শিশু। সে নারীকে মর্যাদা দিতে শিখে না বরং বড় হয়ে নারীকে ভোগের বস্তু মনে করে ইভটিজিংসহ ধর্ষণ, গণধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নারীর রোজগার করা অর্থও নারীকে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে দেয় না, তারা ছলে বলে কৌশলে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে নারীর সম্পদ ও সম্পত্তি, না পেলে হত্যা করতে দ্বিধা করে না। স্ত্রীর সম্মতি ছাড়াই তাকে ভোগের সামগ্রীর মতো ব্যবহার করা হয়। নারীকে লেখাপড়া, মেধার বিকাশ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, স্বাধীনভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে বাধা দেয়া হয়। পুরুষ সমাজ বা তার
প্রতিনিধিরা নারীর গতিবিধি নির্ধারণ করে দেয় ফলে নারী তার মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। নারীর কর্ম দক্ষতা ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয় এবং দিনে দিনে পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এতে করে নারী হয়ে উঠে পরিবার ও সমাজের বোঝাস্বরূপ।
ফতোয়ার নামে চলছে নানাবিধ কায়দায় মৌলবাদীদের দ্বারা নারী নির্যাতন, মৌলবাদী শক্তির প্রভাবে নারীর মেধার বিকাশসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ফলে পিছিয়ে পড়ছে নারীরা। যোগ্যতার লড়াইয়ে তারা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে সমভাবে অংশগ্রহণ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে বিভাজন এখনও রয়েছে, সেই সাথে চলছে মজুরী বৈষম্য। তার উপর নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে নারীরা।
নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নির্যাতন প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য আইনসমূহের মধ্যে-
আমাদের দেশে প্রচলিত হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খৃষ্টান সকলের জন্য ৩টি পারিবারিক আইন রয়েছে। বৌদ্ধদের জন্য পৃথক কোনো আইন নাই তারা হিন্দু পারিবারিক আইনের অধীন। তবে এসব পারিবারিক আইনে বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ ও সন্তানের ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারের অধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া মুসলিম নারীদের দেনমোহর ও হিন্দু পারিবারিক আইনে ছেলে সস্তান দত্তক নেয়ার বিষয়ে আইন প্রণীত হয়েছে। যে সব অধিকার খর্ব হলে পারিবারিক আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করা যায়। প্রচলিত পারিবারিক আইনে একই ধর্মের নারী ও পুরুষদের মধ্যে অধিকারের বৈষম্য রয়েছে, আবার ভিন্ন ধর্মের নারীতে-নারীতে বৈষম্য রয়েছে। যৌতুক বন্ধে আইন ১৯৮০ সালে প্রণীত হলেও যৌতুক দেয়া নেয়া বন্ধ হয় নাই। বহুবিবাহ বন্ধে আইন প্রণীত হয়েছে ১৯৮৫ সালে, এ আইনটিও তেমন সফলতা অর্জন করতে পারে নাই। বাল্য বিবাহ বন্ধের লক্ষ্যে আইন প্রণীত হয়েছে ১৯২৯ সালে, এখনও চলছে বাল্য বিবাহ। নারীর প্রতি সহিংস আচরণ। বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে মামলা করবেন চেয়ারম্যান, যা আইনের প্রয়োগকে বাধাগ্রস্থ করে। বাল্য বিয়ে ও যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেনি।
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ এর বাস্তবায়নের জন্য আমাদের পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে নারীদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হবে এবং নীরবে নির্যাতন সহ্য করার বা নির্যাতনের ফলে আত্মহত্যার সংস্কৃতি পরিহার করে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হবে। এ বিষয়ে তৃণমূলে আইনের তথ্য প্রচার করে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতা থাকতে হবে সেই সাথে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন করতে হবে। প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গী স্বামীই স্ত্রীর অভিভাবক এটি ভ্রান্ত ধারণা- প্রাপ্ত বয়স্ক সকল নর-নারীর স্বাধীন সত্ত্বা রয়েছে। স্বামী বা স্ত্রী কেউ কারও অভিভাবক নয় তারা একে অপরের সহযাত্রী। যে কোন নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী-পুরুষের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এই আইনটির যথাযথ বাস্তবায়ন হলে পরিবারে নারীর সুরক্ষা সক্ষম হবে।
লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করে নারীদের জন্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ ব্যবস্থায় নারীদের সুযোগ প্রদান সাপেক্ষে সমভাবে সকল স্তরে অংশগ্রহণ ও অধিকার ভোগ করার বিষয়ে যোগ্য করে তুলতে হবে। যার মধ্য দিয়ে নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান সরকার নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ ঘোষণা করলেও এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয় নাই। তবে যে নীতির ভিত্তিতে আইন তৈরিসহ বিভিন্ন জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হবে, সেখানে সম্পদ-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমতার কথা উল্লেখ নাই। অর্থনৈতিক মুক্তি ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সকল ধরণের বৈষম্য দূর করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষের সমঅধিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই সাথে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত এবং রাজনীতিতে সকল স্তরে নারীর সমঅংশ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ ব্যবস্থায় সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রসর না হয়ে নারীর অবস্থার কিছুটা উন্নয়ন সম্ভব, তবে নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন চলছে চলবেই। সকল নাগরিক তথা নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সকল প্রগতিশীল শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করার বিকল্প নাই।
লেখক : অ্যাড. মাকছুদা আখতার
Leave a Reply