ডেক্স নিউজ : বিপ্লবী জননেতা কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। দিনটি উপলক্ষে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। শুক্রবার (২২ জুলাই) বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মুজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে এ স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সূচনা বক্তব্য দেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বেলাল চৌধুরী। মুবিনুল হায়দার চৌধুরীকে স্মরণ করে তিনি বলেন, “তাঁকে স্মরণ করার জন্য আমাদের এই সমবেত হওয়া। তিনি বাংলাদেশে প্রায় ৫০ বছর রাজনীতি করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর সান্নিধ্যে গিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। তিনি তাদের উজ্জীবিত করছেন রাজনৈতিক চেতনায়। হায়দার ভাই বাংলাদেশে অবস্থানকালে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। একসঙ্গে রাজনীতি না করলেও তারা কমরেডকে সম্মান করেন। কাজেই দলমত নির্বিশেষে আমরা তাঁকে স্মরণ করতে পারি। জনগণের শোষণমুক্তির জন্য আমরা নিয়মিত সংগ্রাম করে যাচ্ছি। তাঁকে স্মরণ করতে পারলে আমরা আরও বেশি উজ্জীবিত হব। কারণ তিনি সব সময় আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তিনি সব সময় প্রসঙ্গিক এবং তাঁকে ব্যতিরেকে মুক্তি সম্ভব নয়।”
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী আজীবন বিপ্লবী ছিলেন। সেখানে তার কোনো আপস ছিল না। সামাজিক বিপ্লবের জন্য তিনি সারাজীবন কাজ করেছেন। আমাদের হায়দার ভাইয়ের মেরুদণ্ড ছিল বিস্ময়কর রকমের দৃঢ়। কোনো অবস্থাতেই তিনি নড়তেন না। সংকটে থাকতেন ধীর ও স্থির। হায়দার ভাই রাজনীতিক ছিলেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতে দল অনেক; কিন্তু ধারা দুটি। একটি ধারা রক্ষণশীল, অন্যটি বিপ্লবী।”
এই শিক্ষাবিদ আরো বলেন, “রক্ষণশীল ধারার মধ্যে আবার এপার-ওপার আছে; কেউ কট্টরপন্থী, এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল; অন্যরা উদারনীতিক। উদারনীতিকরা সংস্কারপন্থী হতে পারেন, এমনকি বিপ্লবের কথা বলাও তাদের জন্য অসম্ভব নয়। কিন্তু উদারনীতিকেরাও শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীলই। বিপ্লবীরা সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করেন। পথের পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তারা চান সমাজে ও রাষ্ট্রে মৌলিক পরিবর্তন। ধারা দুটি স্বতন্ত্র। হায়দার ভাই বিপ্লবী ধারার রাজনীতিক ছিলেন। কিশোর বয়সেই তাঁকে বিপ্লবের স্বপ্নে পেয়েছিল। আমৃত্যু সেই স্বপ্নকে লালন করেছেন। কিন্তু তিনি তো বিপ্লবকে পাননি। না-পাওয়ার কারণ আমরা সবাই জানি। সমাজে ও রাষ্ট্রে অনেক কিছুই ঘটেছে; কোনো কোনো পরিবর্তন বেশ বড় রকমের, কিন্তু আসল বিপ্লব যে সমাজ বিপ্লব, সেটা ঘটেনি। হায়দার ভাই সেই বিপ্লবকে সম্ভব করবার জন্য নিজের জীবনকে নিযুক্ত করেছিলেন। সরেননি, নড়েননি। কমরেডদের কখনো মৃত্যু হয় না। তদের কেবল প্রস্থান হয় মাত্র। বিপ্লবী চেতনায় ও সমাজের পরিবর্তনের সংগ্রামে কমরেডরা সব সময় বর্তমান।”
ডা. গোলাম রব্বানী বলেন, “আমি ক্ষুদিরামকে দেখিনি, সূর্য সেনকে দেখিনি; কিন্তু দেখছি কমরেড হায়দার ভাইকে। বিপ্লবের জন্য একটি বিপ্লবী দল দরকার। বিপ্লবের মন্ত্রে যে ব্যক্তি আমাদের উদ্দীপিত করেছেন, তাঁর নাম কমরেড হায়দার। বিপ্লবের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার যে দীক্ষা আমরা পেয়েছি, তা আমাদের সামনের পথ দেখাতে সাহায্য করবে। আমরা এখন কমিউনিস্ট চরিত্রগুলো সামনে আনতে চাই। কারণ তারাই কেবল সামনের কথা ভাবতে পারেন। অবিচল দৃঢ চেতনার মানুষগুলোকে আমাদের বারবার সামনে আনতে হবে। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের দুরবস্থা থেকে মুক্তির জন্য তাঁকে বারবার সামনে আনা দরকার।”
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “বয়সের ব্যবধান থাকলেও তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার সকলকে মুগ্ধ করেছে। প্রচুর তুষারপাতেও পাইনগাছ যেমন কখনো নুয়ে পড়ে না, কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীরও তেমনি সকল সংগ্রামে টিকে থাকা মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। সমাজ পরিবর্তনের নানা বিষয়ে পর্যালোচনা করা এই বিপ্লবী একজন পরশপাথর। যার সংস্পর্শে এসে নতুন বোধে এক সংগ্রামী জীবনের অত্মপ্রকাশ ঘটে। ব্যক্তিমালিকানার বাইরে এসে সামাজিক মালিকানায় তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, যা আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা। নিজের চিন্তাকে অন্যের মধ্য দিয়ে বিকশিত করা অত্যন্ত কঠিন কাজ, যে কাজ তিনি করতে পেরেছিলেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় সমাজের বিপ্লবের জন্য অন্যরা কাজ করে গেছেন।”
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি দিগ্বিজয়ী এবং অত্যন্ত উজ্জ্বল একটি নাম। তিনি আমাদের সকলের অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক বাসদ দল যারা করেন, তারা সকলেই তাঁকে স্মরণ করবেন আজীবন। একটা মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে সকলকে উজ্জীবিত করে গেছেন। কেবল বাসদের রাজনৈতিক ধারা নয়, সব ক্ষেত্রেই তাঁকে অনুসরণের বিষয় আছে। গণমানুষের লক্ষ্যে এবং গণমানুষের স্বার্থে যারা কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের জন্য হায়দার ভাই পথপ্রদর্শক। সমাজের মৌলিক রূপান্তর করাই কিন্তু কমিউনিস্টের কাজ। আমাদের আত্ম-জিজ্ঞাসা থাকা দরকার এই মুহূর্তে। শ্রেণিসংগ্রামে আমরা আসলে ফলপ্রসূ কী করছি!”
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী স্মরণ জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক লিয়াকত আলী, অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)-এর কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটির সদস্য শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়ক টিপু বিশ্বাসসহ আরো অনেকে।
Leave a Reply