এ এন রাশেদা : ঘটনাটি নতুন নয়, পুরোনো। সেই আশির দশক থেকেই (১৯৮৪) কালের পরিক্রমায় পাঠ্যসূচি নানাবিধ উন্নয়নের ধারায় বদলাবে, এটাই স্বাভাবিক। এর সঙ্গে বদলাতে পারে মূল্যায়ন পদ্ধতিও। কোনো কিছুতো এক জায়গায় থেমে থাকে না, সবই পরিবর্তন হয়, বিবর্তিত হয়। জীবদেহ যে মাটি দিয়ে তৈরি নয় অসংখ্য কোষ দিয়ে গঠিত, তা জানা যায় দু-জন জার্মান উদ্ভিদবিদের মাধ্যমে ১৮৩৮-১৮৩৯ সালের মধ্যে। আর মৃত কোষ সম্পর্কে জানা যায় তারও আগে ১৬৬৫ সালে বিজ্ঞানী রবার্ট হুকের মাধ্যমে। তারপর একে একে কোষের বিভিন্ন অঙ্গানু যেমন প্লাস্টিড, মাইটোকন্ডিয়া, রাইবোজোম, লাইসোজোম, নিউক্লিয়াস, ক্রোমোজোম এবং ক্রোমোজোমের মধ্যে ডিএনএ (DNA) আরএনএ (RNA) আবিষ্কৃত হয়েছে। এখন ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে অহরহ আত্মীয়তার সন্ধান খুঁজে বের করা হচ্ছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া দেহ থেকেও তা সম্ভব হচ্ছে। কোভিড ভাইরাস যে আর. এন. এ ভাইরাস, তা মানুষ জেনেছে। ১৮৫৯ সালে প্রজাতির উৎপত্তি বিষয়ক ডারউইনের বই প্রকাশের ৯৪ বছর পর ১৯৫৩ সালে ডিএনএ, আবিষ্কৃত হয়েছে। তারপর জিন (Gene) আবিষ্কারের ঘটনা বিবর্তনের পক্ষে হাজারও প্রমাণ হাজির করেছে। যারা ধর্মবিষয়ক পড়াশোনা করেন তাদের বিজ্ঞানের সত্যতা সম্পর্কে খুব বেশি জানার কথা না। কিন্তু তারা বিজ্ঞানের সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন। অথচ তাদের আবদার অনুযায়ী আমাদের বিজ্ঞানের সিলেবাস বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে।
২০২৩ সাল থেকে নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী মূল্যায়ন পদ্ধতি বদলে যাবে–এ ধরনের বক্তব্য শোনা যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন থেকেই। এর ভবিষ্যৎ যে ১৯৮৪’র ‘এসো নিজে করি’, ১৯৯৪-৯৫-এর তথাকথিত ‘একমুখী শিক্ষা’, এবং ২০১০ সালের সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির মতো হবে না- তার নিশ্চয়তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই ধারণা অমূলক হয়নি। ২০২৩ সালের শুরুতেই তার পরিণতি দেখা গেল। নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বিষয়ে দুটি করে বই দেওয়া হয়েছে। তার একটির নাম ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ অন্যটির নাম ‘অনুশীলন বই’। দুই শ্রেণিতেই ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ অর্থাৎ টেক্সটবুক পড়ানো নিষিদ্ধ হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ওই দুই শ্রেণির অর্থাৎ ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলন বই’ এর কয়েকটি অধ্যায়েরও প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। আবার একই সঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের অনুসন্ধানী পাঠ্য বইয়েরও সংশোধন করা হবে, ইত্যাদি। বলাবাহুল্য ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের বিবর্তন সম্পর্কে অধ্যায় আছে- তাই তা বাদ দেওয়া বা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। অথচ শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে কয়েকবার করে বলেছেন এবং এর বিষয়বস্তুও তুলে ধরেছেন, কী আছে, কী নেই তা-ও বলেছেন। তারপরও বইটি তুলে নেওয়া হলো, বলা হচ্ছে সংশোধন করা হবে- তবে তা বিজ্ঞান ধারায়, না ধর্মীয় ধারায়?- সেই প্রশ্ন আসতেই পারে, এই পরিবর্তনের দাবি দুদিক থেকেই এসেছে। বিজ্ঞান বই পরিবর্তনের দাবি, ধর্মীয় ধারায় যারা লেখাপড়া করেছেন তারা করছেন– এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ তারা বিজ্ঞান পড়েননি। আর ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের সংশোধন যারা করবেন, তাদের জানা দারকার যে, যারা বাংলাদেশে বসে ‘ও লেভেলে পড়াশোনা করছে তাদের ক্লাস সেভেনে Evolution, অধ্যায় বইয়ের ১৭ পৃষ্ঠাব্যাপী পড়তে হচ্ছে। আর গুগলে সার্চ দিলেও প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। সেসব কী করে বন্ধ করা যাবে? অথচ এই বইয়ের জন্য তিনটি কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে সংশোধনের জন্য।
আর সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ – অনুসন্ধানী পাঠ’ বইটি যে পাঠদান থেকে প্রত্যাহার করা হলো সেখানে হরোপ্পা, মহেঞ্জোদারোর সভ্যতা থেকে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি, বৌদ্ধ, অশোক, মহাস্থানগড়, ওয়ারী-বটেশ্বর, গুপ্তযুগ, ইলোরা, অজন্তার শিল্পকর্ম, নালন্দা, গৌড়ের শাসন, কুমিল্লার ভোজ বিহার ইত্যাদির বর্ণনার পর সুলতানী আমল- এজন্য কি বইয়ের পাঠদান প্রত্যাহার করা হলো? তাহলে তা হবে দুঃখজনক। জনগণের অর্থ ব্যয়ে বই প্রকাশিত হয়, অথচ অষ্টম শ্রেণিতে আমরা বিস্তৃতভাবে সুলতান আমল, মোঘল আমল রাখতে পারি। তাহলে অপচয় রোধ করা যায়। আর অতীতেও আমরা এইসব ইতিহাস স্কুলের পাঠ্যবইয়ে পড়েছি।
এইসব বই বন্ধের দাবি মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো কোনো শিক্ষক সংগঠন থেকেও উঠেছে। কারণ হিসাবে বোঝা যায়, তারা হয়তো এ ধরনের বিষয় কখনও পড়াননি বা পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত নন। ট্রেনিং কোর্সে অংশ নেয়ার সুযোগ পাননি। সে কারণে আপত্তি আসা স্বাভাবিক। সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার ৯ বছর পরও দেখা গিয়েছিল, লক্ষাধিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেলেও ৪৭ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। সেই কারণে কোচিং সেন্টারের আধিক্য দেখা দিয়েছিল। তবে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন ‘আমলা ও শিক্ষক কর্মকর্তারা’– এ বিষয়ে খবরও প্রকাশিত হয়েছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে এমন অপচয়ের শেষ নেই। যেমন ২৬ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি (ICT) উপকরণ দেওয়া হলেও তখন শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়ার কারণে সেসব অযত্ন আর অবহেলায় পড়েছিল। আবার যেকোনো সংস্কারের কাজ না করে ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে টাকা তুলে নেওয়ার বহু খবর প্রকাশিত হয়। সরকার অনেক প্রতিষ্ঠানের ভবন বানিয়ে দিয়েছে, কিন্তু শিক্ষাদানের জন্য কারিগর যে, শিক্ষক প্রয়োজন এবং সেই শিক্ষকের সম্মানজনক বেতন-স্কেল, বাসা ভাড়াসহ সকল সুবিধা প্রদান যে, রাষ্ট্রের কর্তব্য–তা প্রদানে সরকার অসম্মত। অথচ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন দেশ এবং তার সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছিল যে-অঙ্গীকার, তা আজও উপেক্ষিত। সেই স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও কোনও সরকার সবার জন্য একই পদ্ধতির গণমুখী, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। পারেনি আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকলকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান করতে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করার জন্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি- রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে ৫১ বছর। তারা সবাই ১৭ নম্বর ধারা বাস্তবায়নে অপারগ হয়েছে।
আগামী দিন দাবি করছে সংবিধান বাস্তবায়নে শক্তি সঞ্চয় করার। মুক্তিযুদ্ধের অপরাপর শক্তিকে নিয়ে বৈষম্যহীন সবার জন্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করবার-যে সমাজ হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার। এতে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের সাথে শিক্ষিত এবং শিক্ষক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
Leave a Reply